আবদুল কাদের মির্জা। ছিলেন নোয়াখালী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভয় ও আতঙ্কের নাম। প্রায় চার বছর আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতা ও সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বক্তব্য দিয়ে দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বৃহত্তর নোয়াখালীর ১৩টি আসনের দুয়েকটি ছাড়া বাকি আসনে আমাদের এমপিরা দরজা খুঁজে পাবে না পালানোর জন্য। এটিই হলো সত্য কথা। সত্য কথা বলতে হবে। আমি সাহস করে সত্য কথা বলছি। শুরুতে এই বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি।
আবদুল কাদের মির্জা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। তখন তার বক্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে নানা আলোচনা ও সমালোচনা হয়। তিনি তার বক্তব্যগুলোকে সত্য বচন হিসেবে অভিহিত করতেন। কাদের মির্জা নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার বসুরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। আবদুল কাদের মির্জা ক্ষমতায় থাকাকালে নিজ দলের ভিন্ন মত ও বিরোধী দলগুলোর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিলেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রশাসনের কর্মকর্তারাও ছিলেন তার কাছে অসহায়। তার লালিত হেলমেট ও হাতুড়ি বাহিনীর অত্যাচার-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বিএনপি-জামায়াত-আওয়ামী লীগ তিন দলেরই নেতাকর্মীরা।
টানা সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে কাদের মির্জার কাছে জিম্মি ছিল পুরো কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার মানুষ। ২০২১ সালের ১৬ জানুয়ারির পৌরসভা নির্বাচনে কাদের মির্জা টানা তৃতীয়বারের মতো বসুরহাট পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন। এরপর তিনি অত্যন্ত বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি প্রথমবারের মতো বসুরহাট পৌরসভার তৎকালীন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী, পেশাজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ সাহায্য চাইতে আসা অসহায় ব্যক্তিরাও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন কাদের মির্জার হাতে। পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং গালমন্দ করা ছিল তার নিয়মিত অভ্যাস। গঠন করেন হেলমেট বাহিনী ও হাতুড়ি বাহিনী। ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, সরকারি বিভিন্ন নিয়োগে তদবির বাণিজ্য, ঠিকাদারি কাজে চাঁদাবাজি, শিশুপার্কের নামে কারখানা দখল, আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে বিপণিবিতান ভাঙচুর, বিপণিবিতান বন্ধ করে দেওয়াসহ অসংখ্য অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে কাদের মির্জার বিরুদ্ধে।
৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই বিক্ষুব্ধ জনতা একত্রিত হয়ে যখন তার বাড়ির দিকে রওনা হন তিনি পরিবার নিয়ে পালিয়ে যান। বিক্ষুব্ধ জনতা বাড়িতে ঢুকে ভাঙচুর করে অগ্নিসংযোগ করেন। এখন পর্যন্ত কাদের মির্জার অবস্থান নিয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে তার বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরেরও কোনো খোঁজ নেই।
মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর বড় ভাই ওবায়দুল কাদের ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিতে থাকেন কাদের মির্জা। এ নিয়ে সারা দেশে ব্যাপক সমালোচনার খোরাক হয়। এর প্রতিবাদে স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাংশ মাঠে নামে। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি উপজেলার চাপরাশিরহাটে প্রতিপক্ষের মিছিলে কাদের মির্জার নেতৃত্বে হামলা চালায় তার বাহিনী। মুহুমুর্হু গুলিতে প্রকম্পিত হয় এলাকা। এ ঘটনা চলাকালে সংবাদ সংগ্রহের সময় গুলিবিদ্ধ হন স্থানীয় সাংবাদিক বোরহান উদ্দিন মুজাক্কির। পরবর্তীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মুজাক্কির। এ ঘটনায় মামলা হলেও কারও নাম উল্লেখ করার সাহস পায়নি মুজাক্কিরের পরিবার।
পরবর্তীতে তার হেলমেট বাহিনী স্থানীয় আরেক সাংবাদিক প্রশান্ত সুভাষের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। প্রশান্ত, তার মা ও ছেলেকে কুপিয়ে আহত করা হয়। এরপর এলাকা ছাড়া হন প্রশান্ত। আরেক সাংবাদিক নাজিম উদ্দিনকে পিটিয়ে আহত করা হয়। পরে নাজিমের বিরুদ্ধে উল্টো মাদক আইনে মামলা করেন তিনি।
কোম্পানীগঞ্জে কাদের মির্জার হেলমেট ও হাতুড়ি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন তাশিক মির্জা। এই হেলমেট ও হাতুড়ি বাহিনী মানুষের কাছে সবচেয়ে ভয় ও আতঙ্ক ছিল। ভিন্ন মত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, প্রবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে তা কাদের মির্জার কাছে দেওয়া ছিল তাদের প্রধান কাজ। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ও বসুরহাট পৌরসভায় যেকোনো উন্নয়ন কাজ করতে গেলে কাদের মির্জাকে নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো ঠিকাদারদের। আবার এসব কাজের বেশিরভাগ পেতেন তার ঘনিষ্ঠ ঠিকাদাররা। চাঁদা ছাড়া কেউ কাজ করতে পারেনি।
কাদের মির্জার বাহিনীর হামলার শিকার হন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খিজির হায়াত খান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরনবী চৌধুরী, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বাদল, উপজেলা বিএনপির সদস্য সচিব মাহমুদুর রহমান রিপনসহ আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা।
বিশ^স্ত একটি সূত্রে জানা যায়, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান বাদলকে পাশর্^বর্তী ফেনী জেলার জনপ্রিয় আওয়ামী লীগ নেতা একরামের মতো চলন্ত গাড়ির ভেতর আগুনে পুড়িয়ে হত্যার পরিকল্পনা ছিল কাদের মির্জার। এই পরিকল্পনায় কাদের মির্জার নেতৃত্বে বাদলকে বহনকারী চলন্ত গাড়ির হামলা করা হয়। ঘটনায় তিনি দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে যান। এরপর তাকে কুপিয়ে গুরুতর আহত করা হয়। ভাগ্যক্রমে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ওই সময় থানায় জিডি অথবা মামলা করারও সাহস পায়নি বাদল।
কাদের মির্জা বসুরহাট পৌর মেয়র হওয়ার কারণে পৌরসভা এলাকায় বাড়ি করার প্ল্যান পাসের স্বাক্ষর করাতে হতো জায়গার মালিকদের। প্ল্যান পাসের সময় তিনি জায়গার মালিককে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাঁদা দেওয়ার জন্য বলতেন। চাঁদা না দিলে তার ওপর নেমে আসত নির্যাতন। দখল করা হতো তার জায়গা। পরে বিক্রি করার ভয় দেখিয়ে চাঁদা আদায় করতেন। আবার বাড়ি করার সময়ও আলাদা চাঁদা দিতে হতো তার হেলমেট ও হাতুড়ি বাহিনীকে। বিশেষ করে প্রবাসীরা ছিলেন তার প্রধান টার্গেট।
বসুরহাট বাজারের ব্যবসায়ীরা কাদের মির্জার কাছে ছিলেন অসহায়। নিয়মিত চাঁদা দিয়ে তাদের ব্যবসা করতে হতো। চাঁদা না দিলে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিত তার বাহিনী। পরে চাঁদা দিয়েই আবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলতে হতো ভুক্তভোগীদের। বসুরহাট পৌর এলাকায় এক লন্ডন প্রবাসীর দুটি ভবন দখল করে নেন কাদের মির্জা। এর মধ্যে চার তলা ভবন জোর করে স্ত্রীর নামে লিখে নেন তিনি। ছয় তলা ভবনটিও দখলে নিয়ে ভাড়া তুলতেন কাদের মির্জা। তবে ৫ আগস্টের পর ভবনগুলো দখলমুক্ত করেছেন প্রবাসী। এ রকম অসংখ্য নজির রয়েছে কাদের মির্জার। অবস্থা এমন ছিল যেকোনো প্রতিকার তো দূরের কথা, তার দিকে তাকিয়ে কথাও বলতে সাহস পেত না কেউ।
বসুরহাট পৌরসভা জামায়াতের আমির মোশাররফ হোসাইন বলেন, কাদের মির্জার অপকর্মের কথা এক-দুদিনে শেষ হবে না। তার অপকর্ম এমন পর্যায়ে ছিল যে, তার বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরও ছিল অসহায়। তার কথাও শুনত না কাদের মির্জা। কাউকে পাত্তাই দিতেন না। প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষও তার নির্যাতনের শিকার হতো। তিনি রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় কারও মোটরবাইক পুকুরে ফেলে দিতেন, কেউ তার দিকে তাকালে বা না তাকালেও অযথা চড় মারতেন। রিকশাচালকদের কাছ থেকেও পৌরসভার নাম করে চাঁদা নিতেন। এমন কোনো সেক্টর নেই যেখান থেকে তিনি চাঁদা না নিতেন। তিনি পৌরসভার মেয়র, কিন্তু তিনি উপজেলা পরিষদেরও সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। চেয়ারম্যান ছিলেন তার হাতের পুতুল। নির্বাহী কর্মকর্তারা থাকতেন ভয়ে। মান-সম্মানের কারণে কিছুই বলতেন না। কোনো কাজে অপারগতা অথবা দ্বিমত পোষণ করলে সেই কর্মকর্তাকে নাজেহাল করতেন কাদের মির্জা। আর বিরোধী মত দমনে তিনি তার প্রশাসন, ক্যাডার বাহিনীকে দিয়ে করতেন হয়রানি। এখানেও তার চাঁদাবাজি চলত। যেসব বিরোধী নেতাকর্মীরা তার নির্ধারণ করা চাঁদা দিতেন তারা এলাকায় থাকতে পারতেন। আর যারা দিতে পারত না তাদের এলাকা ছাড়া করতেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বাদল বলেন, কোম্পানীগঞ্জে কাদের মির্জার কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না প্রশাসনসহ সবার। তার জুলুম, অত্যাচার, নির্যাতন, চাঁদাবাজির কথা লিখে শেষ হবে না।
বসুরহাট পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোশারফ হোসেন নাহিদ বলেন, আমি মনে করি ওবায়দুল কাদের বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে শেষ করেছেন, আর কাদের মির্জা শেষ করেছেন নোয়াখালীর আওয়ামী লীগকে। তিনি কাউকেই তোয়াক্কা করতেন না। নিজ দল, বিরোধী দল, সব দলই তার হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অশান্তির জনপদ ছিল এই কোম্পানীগঞ্জ কাদের মির্জার কারণে। ৫ আগস্টের পর থেকে এই এলাকার মানুষ শান্তিতে আছে। যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল তার অত্যাচারে, সেগুলো নতুন করে খোলা শুরু হয়েছে। বাহিনী না থাকায় চাঁদা নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা শান্তিতে ব্যবসা করছেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মাহমুদুর রহমান রিপন বলেন, পুরো দেশের শাসনব্যবস্থা এক রকম। আর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ছিল আরেক রকম। এখানে কাদের মির্জার কথাই সব। ওবায়দুল কাদেরের কথারও কোনো মূল্য ছিল না তার কাছে। কাদের মির্জার নির্যাতনের রূপকথা সবকিছুকে হার মানাবে। তার অপকর্মের কথা কোনটা রেখে কোনটা বলব। সরকারি জায়গায় দোকান তুলে বিক্রি করা, নিয়োগ বাণিজ্য করা, খাস জমি দখলে নেওয়া, প্রবাসী ও বিত্তশালীদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া, চাঁদা না দিলে জায়গা, বাড়িঘর দখল করা, বাহিনী দিয়ে নির্যাতন করা সবই ছিল তার নিত্যদিনের কাজ।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় দায়িত্ব পালন করা একাধিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসি বলেন, আমাদের কাদের মির্জার কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। দ্বিমত হলেই করতেন গালাগাল। অনেক সময় তেড়েও আসতেন। ওবায়দুল কাদেরের কথাও তিনি শুনতেন না।