নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার নিঝুম দ্বীপ। জাতীয় উদ্যান খ্যাত এ দ্বীপে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সারাবছরই পর্যটক আসে নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। এ দ্বীপের প্রধান সড়কের বেহাল দশায় এখানে আগত পর্যটক ও স্থানীয়দের চলাচলে বেগ পেতে হয়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বিভিন্ন সময় ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে সড়কের অনেকাংশে বিশাল বিশাল গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। জোয়ারের পানির স্রোতে সড়কের নিচে মাটি সরে গিয়ে ভেঙে পড়েছে ওপরের আরসিসি ঢালাইয়ের বিভিন্ন অংশ।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় ১২ বছর আগে তৈরি এই সড়কটি ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে একাধিবার চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। প্রতিটি জলোচ্ছ্বাসের পর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সামান্য মাটি দিয়ে খানাখন্দ ভরাট করা হয়। কিন্তু কিছুদিন পর তা আবার গর্তে পরিণত হয়। সবশেষ ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় এই সড়কের ওপর দিয়ে ৬ থেকে ৮ ফুট উচ্চতায় পানি প্রবাহিত হয়। এতে সড়কটি ভেঙে অনেক জায়গায় খালে পরিণত হয়।
গত ৬ মাসে এই রাস্তায় চলাচল করতে গিয়ে অনেকে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে। এর মধ্যে গত জুলাই মাসে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিঝুম দ্বীপ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির ছাত্র সম্পদ প্রাণ হারায়। সম্পদ নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আলা উদ্দিনের ছেলে।
ইউপি সদস্য আলা উদ্দিন জানান, সম্পদ তার এক বন্ধু সহকারে মোটরসাইকেলে নামার বাজার যাওয়ার সময় খাদের মধ্যে পড়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। নিঝুম দ্বীপ প্রধান সড়কের বাতায়ন কিল্লা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে এই দুর্ঘটনা ঘটে। পরে তাকে আহত অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে ঢাকা নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।
এছাড়া, নভেম্বর মাসের প্রথম দিকে ধান বোঝাই একটি টমটম উল্টে এক কৃষক গুরুতর আহত হয়। আবুল কালাম নামে নিঝুম দ্বীপ ৩ নম্বর ওয়ার্ডের ওই কৃষকের একটি পা ভেঙে যায়।
সরেজমিনে দেখা যায়, বন্দরটিলা ঘাট থেকে নামার বাজার যাওয়ার পথে চেউয়াখালী এলাকায় রাস্তায় বিশাল আকারের গর্ত রয়েচে। এখন শুকনো মৌসুম হওয়ায় অনেকে যাত্রী নামিয়ে খালি গাড়ি পার করছেন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল পার হলেও সিএনজি ও টমটম পার করতে অনেক কষ্ট করতে হচ্ছে। দুই তিনজন একসাথ হয়ে ধাক্কা দিয়ে এসব গাড়ি পার করতে হচ্ছে। আবার অনেক জায়গায় রাস্তার পাশে আরসিসি ঢালাই ভেঙে পড়ায় সরু পথ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে যাবাহন চলাচল করছে।
বন্দরটিলা বাজার থেকে তরকারী বোঝাই করে নামার বাজার যাওয়ার সময় আটকা পড়েন সিএনজিচালক জসিম উদ্দিন।
জসিম উদ্দিন জানান, এই ভোগান্তি প্রতিদিন মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এখন গাড়ি থেকে মালামাল নামিয়ে মাথায় করে ভাঙা অংশটুকু পার করতে হবে। তাতে দুই ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। আবার সড়কের অন্য অংশটুকুও ভাঙা তাতে ভালোভাবে গাড়ি চালানো যায় না।
এ সড়কে চলাচলকারী পর্যটকরাও বিভিন্ন সময় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। ঢাকা থেকে ঘুরতে আসা সাকিব নামে একজন জানান, তারা ঢাকা থেকে নিজেরা মোটরসাইকেল নিয়ে এসেছে। তাতেও প্রধান সড়কের ৫-৬টি স্থানে কষ্ট করে পার হতে হয়েছে। নিঝুম দ্বীপের সৌন্দর্য দেখতে অনেকে আসছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কিন্তু প্রধান সড়কের এই অবস্থা দেখে অনেকের মধ্যে এই দ্বীপ সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে।
নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার নুর নাহার বেগম জানান, সিডিএসপি বাজারের পাশে অবস্থিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অন্যান্য সেবার সঙ্গে প্রসুতি রোগীদের সেবা দেওয়া হয়। প্রতি মাসে এখানে গড়ে ৩০ জন রোগীকে নরমাল ডেলিভারি করানো হয়। কিন্তু প্রধান সড়কের বেহাল অবস্থার কারনে এখন দ্বীপের পশ্চিম অঞ্চলের অনেক রোগী এই স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসতে পারে না। এই রাস্তা দিয়ে গর্ভবতী মহিলাদের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আনতে ঝুঁকিতে পড়তে হয়।
উপজেলা প্রকৌশলীর দফতর সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালে আইলা প্রকল্প থেকে করা হয় সড়কটি। বন্দরটিলা ঘাট থেকে নামার বাজার বিচ পর্যন্ত ১০ কিলোমিটারের এই সড়ক সম্পূর্ণ আরসিসি ঢালাই দিয়ে তৈরি করা হয়।
নিঝুম দ্বীপ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়রম্যান দিনাজ উদ্দিন জানান, সড়ক পথে নিঝুম দ্বীপ আসা পর্যটকদের এই রাস্তায় চলাচল করতে হয়। দ্বীপের চার পাশে বেড়িবাঁধ নেই। এতে অস্বাভাবিক জোয়ার হলে এই সড়কের উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। অনেক আগে তৈরি করা সড়কটি বিভিন্ন ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে ভেঙে গেলেও তা মেরামত করা হয়নি। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে মাঝে মধ্যে মাটি দিয়ে গর্ত ভরে দেওয়া হয়। কিন্তু বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানিতে তা আরও দুর্ভোগ বাড়িয়ে দেয়। সড়কটি নতুন করে তৈরি করতে সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে হাতিয়া উপজেলা প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদুল ইসলাম বলেন, রাস্তাটি আরসিসি ঢালাই দিয়ে তৈরি করায় মেরমাত করা যায় না। এটি সম্পূর্ণ নতুন করে তৈরি করতে হবে। ইতোমধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ডিও লেটারসহ একটি প্রস্তাবনা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশাকরছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই রাস্তাটি নতুন করে তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু হবে।