জীবগোষ্ঠীর সার্থক বাসভূমি হলো এই পৃথিবী। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ছোট বড় উদ্ভিদ ও প্রাণীর সমাবেশ লক্ষ করা যায়।
জীববৈচিত্র্য বা বায়োডাইভার্সিটি হলো পৃথিবীতে জীবনের জৈবিক বৈচিত্র্য এবং পরিবর্তনশীলতা। পৃথিবীর মাটি, পানি ও বায়ুতে বসবাসকারী সব উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবদের মধ্যে যে জিনগত, প্রজাতিগত ও পরিবেশগত (বাস্তুতান্ত্রিক) বৈচিত্র্য দেখা যায় তাকেই জীববৈচিত্র্য বলে।
পৃথিবীর ১০ বিলিয়ন ভাগের একভাগ অংশতেই ৫০ মিলিয়ন প্রজাতির বিভিন্ন জীবজন্তু এবং উদ্ভিদের বসবাস। জীববৈচিত্র্যকে নানাভাবে সংজ্ঞায়িত করা যায়; যেমন- জাতিসঙ্ঘের পরিবেশ কর্মসূচির মতে জীববৈচিত্র্য হলো কোনো অঞ্চলের অন্তর্গত সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর জিনগত, প্রজাতিগত ও বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্নতা। সি জে ব্যারোর মতে, জীববৈচিত্র্য হলো একটি অঞ্চলের অর্থাৎ একটি বাস্তুতন্ত্রের অন্তর্গত বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে বৈচিত্র্য।
নামকরণ ও ব্যুৎপত্তি : ১৯৬৮ সালে ‘বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি’ কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন বন্যপ্রাণী বিজ্ঞানী ও সংরক্ষণবিদ রেমন্ড এফ ডাসমান।
‘বায়োডাইভার্সিটি’ কথাটি সর্বপ্রথম ১৯৮৫ সালে ডব্লিউ জি রোজেন ও পরে ১৯৮৮ সালে ব্যবহার করেন পতঙ্গবিদ ইও উইলসন।
জীববৈচিত্র্যের শ্রেণী বিভাগ : জীববৈচিত্র্যকে প্রধানত তিনটি ভাগে বা স্তরে বিভক্ত করা হয়। যথা-জিনগত বৈচিত্র্য, প্রজাতিগত বৈচিত্র্য এবং বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য।
জিনগত বৈচিত্র্য হলো একটি প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির মধ্যে প্রাপ্ত জিনের সব রকমের পার্থক্য। বিজ্ঞানীরা এই জিনগত বৈচিত্র্যকে কাজে লাগিয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষা করেন এবং মানুষের জন্য উপভোগ্য করেন।
প্রজাতিগত বৈচিত্র্য হলো কোনো বাস্তুতন্ত্রে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের উপস্থিতি। এই বৈচিত্র্য থেকে প্রজাতির সংখ্যা, শ্রেণি ও বর্ণ জানা যায়। স্পেসিস ডাইভার্সিটি সহজলভ্য পানির প্রাপ্তির ওপর নির্ভরশীল। নিরক্ষীয় অঞ্চলে বেশি বৃষ্টিপাত হবার কারণে অরণ্য বাস্তুতন্ত্রে প্রজাতিগত বৈচিত্র্য বা স্পিসিজ ডাইভার্সিটি সবচেয়ে বেশি। বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইলসনের (১৯৯২) মতে বিশ্বে ১০- ৫০ মিলিয়ন জীবিত প্রজাতি আছে। তবে এ পর্যন্ত কেবল ১.৫ মিলিয়ন জীবিত প্রজাতির এবং ৩,০০,০০০ জীবাষ্ম প্রজাতি আবিষ্কার করে নামকরণ করা গেছে। ইতোমধ্যে বহু প্রজাতির প্রকৃতির সাথে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারায় বিলুপ্তি ঘটেছে।
বাস্তুতান্ত্রিক জীববৈচিত্র্য একটি বিরাট অঞ্চলজুড়ে বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের প্রকারভেদকে বাস্তুতান্ত্রিক জীববৈচিত্র্য বা ইকোসিস্টেম ডাইভার্সিটি বলে।
জীববৈচিত্র্যের গুরুত্ব : জীববৈচিত্র্য অতীব প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। পৃথিবীতে খাদ্য-খাদক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রাণী ও কীটপতঙ্গ বেঁচে থাকে। বাস্তুতন্ত্র গতিশীল ও কার্যকর হয়। পরিবেশ রক্ষা ও দুর্যোগ নিবারণের ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্যের কার্যকর প্রভাব আছে যেমন, ম্যানগ্রোভ অরণ্য ক্রান্তীয় ঘূর্ণাবর্ত ও সুনামির প্রভাব থেকে উপকূল অঞ্চলকে অনেকটাই রক্ষা করতে পারে। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রক্ষা করা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা, আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক মূল্যবোধ তৈরি করা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও জীববৈচিত্র্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে। জীববৈচিত্র্যের অর্থনৈতিক উপযোগিতা আছে। জীববৈচিত্র্য আছে বলে মানুষ খাদ্যের জোগান পায়, শিল্পের কাঁচামাল পায়, বিনোদন ও পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে পারে। ওষুধ প্রস্তুত করার জন্য ভেষজ কাঁচামালের জোগান জীববৈচিত্র্যই নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য : বিজ্ঞানীদের নানা হিসাব মোতাবেক জীব প্রজাতির সংখ্যা (জীবন্ত) ৩০ লাখ থেকে তিন কোটি, তন্মধ্যে প্রায় ১৪ লাখ শ্রেণীবিন্যস্ত হয়েছে এবং তাতে আছে প্রায় আড়াই লাখ উদ্ভিদ, সাড়ে সাত লাখ কীটপতঙ্গ, ৪১ হাজার মেরুদণ্ডী, বাকিরা অন্যান্য অমেরুদণ্ডী, ছত্রাক, শৈবাল ও অণুজীব। এখনো অনেক প্রজাতি অনাবিষ্কৃত। এ বৈচিত্র্যের অধিকাংশই রয়েছে পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলে, আর্দ্র-উষ্ণ এলাকায়, বিশেষত বনাঞ্চলে। বাংলাদেশে ১৭৫ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ রয়েছে। আট থেকে দশ হাজার বছরের পুরনো কৃষি সভ্যতার ধারাবাহিকতার ফসল হলো এখানকার চাষিদের হাতে উৎপন্ন ধান, পাট, আখ, তুলা, তিসি, সরিষা, সবজি, ফলমূল ইত্যাদির অজস্র প্রকারভেদ। বসতবাড়ির আঙিনায়ও অনেক জাতের গাছগাছড়া জন্মে।
প্রাণিজ জীববৈচিত্র্য : বাংলাদেশ প্রাণিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ীরা এ দলের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের বনভূমি ও জলাভূমি মেরুদণ্ডী প্রাণীতে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের প্রায় ১,৬০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডীর মধ্যে রয়েছে ৬৫৩ প্রজাতির মাছ, ৩২ প্রজাতির উভচর, ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬২৮ প্রজাতির পাখি ও ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন ফর ন্যাচার, বাংলাদেশের তথ্যমতে, দেশে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীই আজ বিপন্ন। বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ৫৪ প্রজাতির মাছ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, স্থায়ী বাসিন্দা পাখি ৪০ এবং অভ্যন্তরীণ স্তন্যপায়ী ৪০ প্রজাতির। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের অন্যতম নিদর্শন আমাদের জলাভূমিগুলো। পৃথিবীবিখ্যাত সুন্দরবন ও টাংগুয়ার হাওর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দুটি জলাভূমি (রামসার সাইট)। টাংগুয়ার হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে হাওরটিতে।
হাজার মাইল অতিক্রম করে অসংখ্য পরিযায়ী পাখির আগমনও বাংলার জীববৈচিত্র্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাড়ে ছয় শতাধিক পাখির মাঝে জলচর পাখিই বেশি। জলাভূমির পাখির ১০ শতাংশ স্থানীয়, বাকি ৯০ শতাংশই অতিথি পাখি। এর মাঝে রয়েছে ২৮ প্রজাতির হাঁস এবং ১৮ প্রজাতির গাঙচিল।
জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে বাংলাদেশে : সম্প্রতি টিআইবির গবেষণায় বলা হয়, বন উজাড় হওয়ায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংসসহ পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের সর্বত্র বন উজাড় হচ্ছে এবং বন্য প্রাণী নিধন হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে এই হার অন্য দেশগুলোর চাইতে বেশি। টিআইবি জানায়, জাতিসঙ্ঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে বার্ষিক বন উজাড় হওয়ার হার বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ, ২.৬ শতাংশ। গত ১৭ বছরে বাংলাদেশে প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে। আর বন বিভাগের হিসেবে সারা দেশে দখল হয়ে গেছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৩ একর বনভূমি।
বাংলাদেশের ১১৯ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ স্তন্যপায়ীর মধ্যে ৪০টি নানা পর্যায়ের বিপদের সম্মুখীন। ১১ অত্যন্ত বিপন্ন, ১৩ বিপন্ন, ৬ বিপন্নপ্রায়। বর্তমানে ১৭ প্রজাতি বিপদমুক্ত। বঙ্গোপসাগরের স্তন্যপায়ীর মধ্যে ৩ প্রজাতির তিমি পৃথিবীর সর্বত্রই বিপন্ন। নীল তিমি ও পাখনাওয়ালা তিমি বিপন্ন এবং কুঁজো তিমি বিপন্নপ্রায়।
জলে-স্থলে এবং অন্তরীক্ষে সর্বত্রই কোনো না কোনোভাবে জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপে জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। আমরা সবাই জানি, মহামারী, দুর্ভিক্ষ আর যুদ্ধবিগ্রহের কারণে জীববৈচিত্র্যের অনেক পরিবর্তন ঘটে থাকে। ইতিহাস সাক্ষী যে এ সবই মানবসৃষ্ট। আমাজনের গহিন জংগলে, সমুদ্রের গভীর তলদেশে কিংবা অসীম মহাশূন্যে কোথাও জীববৈচিত্র্যের কোনো ধ্বংসের চিহ্ন নেই।
জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণ : সমগ্র বিশ্বেই জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটে চলেছে। ইউনাইটেড ন্যাশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের হিসাবে বিশ্বে প্রায় ২.২ কোটি জীব প্রজাতি রয়েছে। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ৭০ লাখ জীবপ্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। পাখি ও সরীসৃপসহ নানা প্রজাতির মধ্যে যথাক্রমে তিন-চতুর্থাংশ ও এক-চতুর্থাংশ বিলুপ্তির পথে। নির্বিচার অরণ্য ধ্বংসের ফলে মোট সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রায় ১০ শতাংশ আজ বিলুপ্তপ্রায়। উদ্ভিদ ও প্রাণীর এই বিলুপ্তির একাধিক প্রাকৃতিক, মনুষ্যসৃষ্ট এবং মিশ্র কারণ রয়েছে।
জলবায়ুর পরিবর্তন : বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক যুগে একাধিকবার জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। এর পরিবর্তনের সাথে বিভিন্ন প্রজাতি অভিযোজন ঘটাতে না পারায় তাদের বিলুপ্তি ঘটেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাকৃতিক কারণের সাথে মানবসৃষ্ট কারণ যুক্ত হয়ে আজ বিশ্ব জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে।
জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির মনুষ্যসৃষ্ট কারণসমূহ : পৃথিবীতে জনসংখ্যার অত্যধিক চাহিদা পূরণ করার জন্য নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করা হচ্ছে। এর ফলে উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রজাতি ও প্রাণী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক প্রাণীর বিচরণের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দরকার। তাদের আবাসস্থলের সংকোচন হলে তারা ঠিকমতো প্রজনন করতে পারে না। মানুষের তথাকথিত উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ, যেমন বনাঞ্চল কেটে কৃষিজমির সম্প্রসারণ, আবাসন প্রকল্প তৈরি, কলকারখানা স্থাপন প্রভৃতির জন্য অরণ্যাঞ্চল ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে ও জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটছে।
বিদেশ থেকে আগত প্রজাতি : যেকোনো বাস্তুতন্ত্রের নিজস্ব গঠনবৈচিত্র্য থাকে। বাইরে থেকে হঠাৎ কোনো প্রজাতি এলে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রের গঠন বিনষ্ট হয়। এতে স্থানীয় প্রজাতির বৈচিত্র্য ভীষণভাবে হ্রাস পায়।
বন্যপ্রাণীর সংহার : বিভিন্ন বন্যজীব নির্বিচারে হত্যা করার ফলে সেই প্রজাতিগুলো ক্রমান্বয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া, গণ্ডারের খড়গ প্রভৃতির জন্য সেই জীবদের এমন হারে হত্যা করা হয়েছে যে বর্তমানে তারা বিলুপ্তপ্রায় বলে গণ্য হচ্ছে।
অত্যধিক হারে উদ্ভিদ আহরণ : বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো তাদের চাহিদা পূরণ করার জন্য বনাঞ্চল থেকে নির্বিচারে বিভিন্ন বৃক্ষলতা ও গুল্ম আহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনাঞ্চল থেকে ভেষজ গুণসম্পন্ন গুল্মগুলো সংখ্যায় অতি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে।
বিভিন্ন প্রকারের দূষণ : সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতে জলদূষণ, বায়ুদূষণ ও মাটি দূষণের মাত্রা প্রভূত পরিমাণে বাড়ছে। দূষণের ফলে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। এর পেছনে কৃষিক্ষেত্রে ব্যবহৃত কীটনাশকই মুখ্যত দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। অধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের জন্য কৃষি জমির জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে চিলজাতীয় পাখির সংখ্যা হ্রাসের কারণও প্রকৃতির দূষণ।
পরিকল্পনাবিহীন উন্নয়ন : যেকোনো উন্নয়নকাজে হাত দেয়ার আগে পরিবেশের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে সমীক্ষা করে নেয়া প্রয়োজন। রাস্তা, রেললাইন, ব্রিজ, বাঁধ, অপরিকল্পিত জলাধার-খাল নির্মাণ, খাল নদী ভরাট, খনি, অরণ্যনিধন, অপরিকল্পিত কৃষিজমি ও আবাসভূমির সম্প্রসারণ, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। দেশে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু বাঁধ, জলাধার, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলোর পরিবেশগত ঝুঁকি আগে থেকে বিশ্লেষণ করা হয়নি। এর ফলে এসব পরিকল্পনা রূপায়ণে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে।
অপর্যাপ্ত আইনি ব্যবস্থা : জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য আজ পর্যন্ত সঠিক ও পর্যাপ্ত আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়নি। ফলে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণী নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে। এ ছাড়া প্রচলিত আইনগুলো প্রয়োগ করা হচ্ছে না। যত দিন না উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও কঠোরভাবে বলবৎ করা হবে- তত দিন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অসম্ভব।
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ : ‘আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা’ (আইইউসিএন) বিপন্ন বা লুপ্তপ্রায় জীবপ্রজাতির যে একটি বিশদ তালিকা প্রকাশ করেছে সেটি রেড ডাটা বুক নামে পরিচিত। রেড বুক লিস্ট অনুসারে বর্তমানে প্রায় ১,৪২,৫০০টি প্রজাতিকে বিপন্ন বলা হয়েছে। অবলুপ্তির প্রকার ও গুরুত্বের সাপেক্ষে এদের আবার নয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা- লুপ্ত, বন্য পরিবেশে লুপ্ত, চরম বিপন্ন, বিপন্ন, বিপদাপন্ন, বিপদের স্বল্প লক্ষণ, অনুদ্বিগ্ন প্রজাতি, স্বল্প জ্ঞাত, অনির্ধারিত বা অমূল্যায়িত। যে তালিকায় অবলুপ্তির বিপদমুক্ত জীবপ্রজাতির উল্লেখ থাকে, তাকে গ্রিন ডাটা বুক বলে। যে তালিকায় ক্ষতিকর বা হানিকর জীবপ্রজাতিসমূহের উল্লেখ থাকে, তাকে ব্লাক ডাটা বুক বলে।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা : স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ সেল ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯২ সালের ২২ মে বাংলাদেশ বায়োডাইভার্সিটি (সিবিডি) চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বর্তমানে এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ১৯৫টি।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে সরকার শুধু গুরুত্বই দেয়নি সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’
এ ছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণে আইন রয়েছে। রয়েছে পরিবেশ আদালতও। যা দেশের পরিবেশবাদী মানুষের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ব্যাপার। দেশে গড়ে তোলা হয়েছে জাতীয় উদ্যান, সাফারি পার্ক, অভয়ারণ্য। জাতিসঙ্ঘের জীববৈচিত্র্য সনদের পক্ষ হিসাবে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন’ প্রণয়ন করেছে।
লেখক : স্বাস্থ্যবিষয়ক নিবন্ধকার ও কলামিস্ট