নোয়াখালী:
নোয়াখালীতে পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই চলছে বেসরকারি পাঁচ শতাধিক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্র নিয়ে আর পরে নবায়ন করেনি। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়পত্র নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও অনুভব করেনি। পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকায় এসব হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিকে নেই কোনো মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। যেখানে-সেখানে তাদের ফেলা বর্জ্য পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবেশসম্মতভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না হওয়ায় মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে আছে সাধারণ মানুষ। পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করে প্রতিবছর লাইসেন্স নবায়ন করছে কিছু প্রতিষ্ঠান।
পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, নোয়াখালীতে প্রায় পাঁচশতাধিক বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টার রয়েছে যার মধ্যে ১৩টি হাসপাতাল ও ১৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ মোট ৩১টা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। এছাড়া তাদের কাছে পাঁচটা প্রতিষ্ঠানের আবেদন জমা ও ২টা আবেদন অনুমোদন করে ছাড়পত্রের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর বাহিরে ৩৬টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ৩৮টি ডায়গনস্টিক সেন্টার গত বছরের বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করলেও নির্দিষ্ট শর্ত পূরণ না করায় তা বাতিল করে পরিবেশ অধিদপ্তর। পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশোধন) আইন, ২০১০ অনুযায়ী যে কোনো বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার নিবন্ধিত হওয়ার আগেই পরিবেশ ছাড়পত্র নেওয়াটা বাধ্যতামূলক।
সিভিল সার্জন কার্যালয় তথ্য মতে, ২০২২/২৩ অর্থবছরে নোয়াখালীতে ১০২টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেছে। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরে ছাড়পত্র থাকা ৩১টি প্রতিষ্ঠানের বাহিরে বাকি ৭১টি প্রতিষ্ঠান কিভাবে তাদের লাইসেন্স নবায়ন করেছে সে ব্যাপারে কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারেনি সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসা কাজে ব্যবহৃত সরঞ্জামের ক্ষতির মাত্রাভেদে সেগুলোকে ৬ ভাগে ভাগ করে ছয় রঙয়ের পাত্রে রাখার নিয়ম। যেসব সরঞ্জাম পুনরায় ব্যবহার করা যায় সেগুলোকে অটোক্লেভ যন্ত্রের মাধ্যমে সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করা বাধ্যতামূলক। প্রান্তিক পর্যায়ের অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিকে তা মানা হচ্ছে না। এমন ব্যবহার পরবর্তীতে একই স্থানে ফেলা হচ্ছে রোগীর ব্যবহৃত সরঞ্জাম ও সাধারণ বর্জ্য। এতে করে চিকিৎসক, নার্স, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, অন্যান্য রোগী এমনকি সঙ্গে থাকা স্বজনরাও নানা রোগব্যাধি আক্রান্তের ঝুঁকিতে রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক অনার্স অ্যাসোসিয়েশন নোয়াখালী সদর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক এবং মা ও শিশু হসপিটালের চেয়ারম্যান অসীম রায় নয়ন বলেন, আমাদের সমিতির অধীনে প্রায় পঞ্চাশটির মতো হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৭/৮টির মতো প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ অধিদপ্তরে ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে। আমরা চাই সকল নিয়ম এবং শর্ত মেনেই আমাদের ব্যবসা পরিচালনা করতে। কিন্তু আমরা আবেদন করার পর দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেও আমাদের প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র মেলেনা। এ প্রক্রিয়াকে আমাদের জন্য আরও সহজ করা প্রয়োজন।
এদিকে, নোয়াখালী পৌর এলাকার সকল সরকারি, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর বর্জ্য অপসারণের দায়িত্ব পায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘শরণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’। নোয়াখালী পৌরসভার পক্ষ থেকে চুক্তি সাপেক্ষে তারা এ কার্যাদেশ পায়। মাসিক চুক্তিভিত্তিতে তারা পৌর এলাকার হাসপাতাল ও ক্লিনিক গুলো থেকে বর্জ্য অপসারণ করে থাকে। যদিও তাদের নিজেদেরই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নেই। পরিবেশ ছাড়পত্র ছাড়াই তারা পৌরসভার কার্যাদেশ কিভাবে পেয়েছে তা নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। তাছাড়া তারা বর্জ্যসমূহ অপসারন করে পৌরসভার ডাম্পিং সাইটে বিধিবহির্ভূতভাবে অপসারন করা হচ্ছে। শহরের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসমূহে বর্জ্য একই ড্রামে অথবা একই গাড়িতে করে পরিবহন করে একই স্থানে রাখা হচ্ছে। এতে করে পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী ও চলাচলরতরা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।
নোয়াখালী পৌরসভার পক্ষ থেকে হাসপাতালের বর্জ্য অপসারণের কার্যাদেশ পাওয়া প্রতিষ্ঠান ‘শরণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’র পরিচালক মো. আবুল বাশার বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেছি। জেলা স্বাস্থ্য কমিটির মিটিং এ জেলা প্রশাসক আমাদের এ ব্যাপারে তাগিদ দেন। আর হাসপাতাল থেকে সংগ্রহ করা সকল বর্জ্য পৌরসভার ডাম্পিং স্টেশনে ফেলার যে অভিযোগ উঠেছে সে বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখছি।
নোয়াখালী পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা শ্যামল কুমার দত্ত বলেন, নোয়াখালী পৌরসভার পক্ষ থেকে ‘শরণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’কে পৌর এলাকার সকল সরকারি এবং বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর বর্জ্য অপসারণের কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। কার্যাদেশ দেওয়ার সময় তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তারা হাসপাতাল ক্লিনিক থেকে বর্জ্যগুলো সংগ্রহ করে তা নিয়ে যাবে বাংলাবাজার। সেখানে তাদের একটি বর্জ্য পোড়ানোর চুল্লি (ইনসিনেটর) আছে বলে আমাদের জানিয়েছে। তারা সাধারণ ময়লাগুলো আমাদের পৌরসভার ডাম্পিং সাইটে দিয়ে দেবে এবং বিষাক্ত বর্জ্যগুলো তাদের ইনসিনেটরে নিয়ে যাবে এবং সেখানে এগুলো পুড়িয়ে নিঃশেষ করবে। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে আমাদের একটি চুক্তি হয়েছে এবং একটি মিটিং হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের বলে দেওয়া হয়েছে, হাসপাতালের সকল বর্জ্য যদি তারা আমাদের ডাম্পিং স্টেশনে নিয়ে যায় তাহলে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে দেওয়া হবে। আমাদের ডাম্পিং স্টেশনে হাসপাতালের বর্জ্য খেলার বিষয়ে তাদেরকে বারবার নিষেধ করা হয়েছে এবং গতমাসে একবার তাদের গাড়িও আটকে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া তাদের পরিবেশের ছাড়পত্র না থাকার বিষয়টি আমরা অবগত আছি। এটা নিয়েও আমাদের মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা পরিবেশ অধিদপ্তরে ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেছে। কিন্তু তাদের ছাড়পত্র দেওয়া হয়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকা একটি প্রতিষ্ঠান কিভাবে বর্জ্য অপসারণের জন্য কার্যাদেশ পায় এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তারা বলেছে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র নিবে। এখন তারা যদি তা নিতে না পারে তাহলে আমরা অন্য পার্টি দেখবো। পরিবেশ ছাড়পত্র তো আমাদের (নোয়াখালী পৌরসভার) ও নেই। এখন কাউকে না কাউকে তো দিতেই হবে। আমাদেরই তো কোনো ছাড়পত্র নেই। আমাদের কাছে যারাই এসেছে তাদের কারোই ছাড়পত্র ছিল না। এর আগে আমাদের পৌরসভার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ ছিল ‘ইনোভেশন সেবা সংস্থার’। তাদের কিছুই ছিল না। নিজেদের জায়গাও ছিল না। ‘শরণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা’র তো একটা ইনসিনেটর আছে বলে জেনেছি। পরিবেশ ছাড়পত্র আছে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান তো আমাদের কাছে আসে না। আর আমাদেরও এমন কোনো জায়গা নাই যে আমরা সিস্টেমটা করতে পারি। নিয়ম কিন্তু প্রত্যেকটা প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের ইনসিনেটর করে তারা ছাড়পত্র নেওয়া। নোয়াখালীতে যে সকল প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ছাড়পত্র আছে তাদের একজনর ও কিন্তু ইনসিনেটর নেই। তাহলে তারা কিভাবে ছাড়পত্র পেয়েছে?
পরিবেশ অধিদপ্তর নোয়াখালীর উপ-পরিচালক মিহির লাল সরদার বলেন, নোয়াখালীর ১৩ হাসপাতাল ও ১৮ ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ মোট ৩১ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ ছাড়পত্র রয়েছে। এছাড়া, পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের আবেদন জমা ও ২ টির আবেদন অনুমোদন করে ছাড়পত্রের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর বাহিরে চার শতাধিক হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরের দেওয়া শর্ত পূরণ না করায় গত বছরের বিভিন্ন সময়ে ৭৪টি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের করা আবেদন বাতিল করা হয়েছে। আমাদের কাছে কোনো আবেদন জমা পরলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে ২১ কার্য দিবসের মধ্যে সেটির পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দিয়ে থাকি। যে সকল প্রতিষ্ঠানের আবেদন বাতিল করা হয় তাদেরও চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা কেবলমাত্র আবেদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আমরা আবেদন পরবর্তী তদন্ত শেষে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে প্ররিবেশ অধিদপ্তরে দেওয়া শর্ত সমূহ পূর্ণ করার জন্য তাদের চিঠি ইস্যু করি।
নোয়াখালী জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাসুম ইফতেখার বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের লাইসেন্স নবায়ন করার সুযোগ নেই। তারপরও যদি এখানে কোনো অসঙ্গতি থেকে থাকে সে বিষয়টি আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।