নোয়াখালী প্রতিনিধি >
নোয়াখালীতে প্রশাসনের যোগসাজশে গণপূর্ত অধিদপ্তরের শতকোটি টাকার সম্পত্তি বেদখল হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। মাইজদী হাসপাতাল রোডের মধুসুদনপুর মৌজায় সাড়ে ৫ একর সরকারি জায়গায় গড়ে উঠেছে বাহারি নামের বিশাল বিশাল হাসপাতাল। এছাড়া শহরের অন্তত আরও কয়েকশ একর জায়গায় ঘেরাও দিয়ে মাটি ফেলে দখলের হরিলুট চলছে। কর্তৃপক্ষ দেখেও যেন না দেখার ভান করছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভূমি অফিসের তথ্য অনুযায়ী মাইজদীর হাসপাতাল রোডের পাশে মধুসুদনপুর মৌজায় গণপূর্ত অধিদপ্তরের নামে ৫ একর ৪৭ শতাংশ জায়গা রেকর্ড করা আছে। দীর্ঘদিন তদারকি না থাকায় ওইস্থানে একের পর এক গড়ে উঠছে বহুতল ভবন। নকশা অনুযায়ী গড়ে উঠা প্রাইম হাসপাতাল, মুন হাসপাতাল, বি.এল নাগসহ অসংখ্য বহুতল ভবন গণপূর্তের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। গত কিছুদিন আগে ওই মৌজার ৪০ নম্বর দাগে গণপূর্তের জায়গায় মুন হাসপাতাল নামে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করলেও কর্তৃপক্ষ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
ভূমি অফিস সূত্র জানায়, ১৯৮৮ সালের ২৩ জুন ২৩/৮৭-৮৮ নম্বর বাজে নথীমূলে এক আদেশে মাইজদী মধূসূদনপুর মৌজায় ৭০ নম্বর খতিয়ানে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীর নামে ১৯টি দাগে ৫ একর ৪৭ শতাংশ জায়গা রেকর্ড করা হয়। এরমধ্যে ৩৯ দাগে ২৬, ৪০ দাগে ১৬, ৪৩ দাগে ৯, ৪৫ দাগে ৩৫, ৪৬ দাগে ৭৯, ৪৮ দাগে ৩০, ৪৯ দাগে ৩৫, ৫০ দাগে ২৪, ৫১ দাগে ৪০, ৫২ দাগে ৩২, ৫৩ দাগে ৬, ৫৪ দাগে ৩৭, ৫৫ দাগে ৩৬, ৫৬ দাগে ৩৫, ৭২ দাগে ৫৩, ৭৩ দাগে ২৭, ৭৭ দাগে ৭, ৭৮ দাগে ৯ ও ৭৯ দাগে ১১ শতাংশ জায়গা রেকর্ড রয়েছে।
গণপূর্ত কার্যালয় সূত্র জানায়, মাইজদী হাসপাতাল রোডের সেন্ট্রাল হাসপাতালের পশ্চিম দিক থেকে রাস্তা বাদ দিয়ে উত্তর পাশে ৪০ ফুট প্রশস্তের বিশাল জায়গার মালিক গণপূর্ত অধিদপ্তর। এখানে সাড়ে ৫ একরে মধ্যে কোথাও কোনো জায়গা লীজ বা হস্তান্তর করা হয়নি। তবুও ওইসব দাগের মালিকদের থেকে পিছনের অংশ খরিদ করে অনেকে সামনের অংশে গণপূর্তের জায়গা দখল করে বসে আছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মধূসুদনপুর মৌজার ৪০ দাগের ৫৩ শতাংশ জায়গার মধ্যে সামনের ১৬ শতাংশ গণপূর্তের এবং ৩ শতাংশ সড়ক ও জনপদের নামে রেকর্ড করা। বাকি ৩৪ শতাংশ ব্যক্তি মালিকানাধীন। এখানে পেছনের ওই ৩৪ শতাংশ থেকে ভূমি খরিদ করে অনেকে রাস্তার পাশে গণপূর্তের জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে দখল করে আছেন। কর্তৃপক্ষ বিষয়টি জেনেও উদাসীন।
মুন হাসপাতাল ভবনের মালিক ডা. মো. সাজেদুল আলম সাজু ৪০ দাগে ৩৪ শতাংশ থেকে ৩৩১ নম্বর জমাখারিজ খতিয়ানে খরিদসূত্রে ৪ শতাংশ ভূমির মালিক। নকশা অনুযায়ী তার জমি পেছনে হলেও তিনি রাস্তার পাশে গণপূর্তের জমিতে ‘মুন হাসপাতাল’ নামে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করেছেন। তার পাশে একই দাগে ডা. বি.এল নাগ ও পাশের দাগে প্রাইম হাসপাতাল নামে আরও একটি বিল্ডিংয়ের খুটি স্থাপন করা হয়েছে।
এছাড়াও ডক্টর ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্সসহ আরও শতাধিক দোকান ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন প্রভাবশালীরা।
ডক্টর ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স ভবনের মালিক মো. শাহীন উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেন, আমি ২০০৩ সালে ৮ শতাংশ জমি খরিদ করে বিল্ডিং করি। গণপূর্তের জমি হলে তো আমাকে নোটিশ পাঠাতো। গত ২০ বছরে কেউ আমাকে বিষয়টি জানায়নি।
নোয়াখালী প্রাইভেট হসপিটাল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক বোরহান উদ্দিন মিঠু গণপূর্তের জমি দখল করে jhjশতাধিক দোকান নির্মানের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, গণপূর্তের মূল্যবান জমিটি পরিত্যক্ত থাকায় স্থানীয় লোকজন দখল করে দোকানপাট নির্মান করে ভাড়া দিয়ে আসছে। প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় দখলের পরিমান দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জানতে চাইলে মুন হাসপাতালের ভবনের মালিক ডা. মো. সাজেদুল আলম সাজু গণমাধ্যমকে বলেন, আমার বিল্ডিংয়ের পিলারের বাহিরে সামান্য অংশ গণপূর্তের জমিতে পড়েছে। কর্তৃপক্ষ চাইলে সেটি ভেঙে দিতে পারে। কিন্তু রাস্তার থেকে ৪০ ফুট গণপূর্তের জমি, এতে মুন হাসপাতালের বেশিরভাগ অংশ খাস জমিতে পড়েছে- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কর্তৃপক্ষ যা করার করুক। তারা মেপে লাল দাগ দিয়ে গেছে। বাকিটা নকশা দেখলে বুঝা যাবে।
অন্যদিকে ডা. বি.এল নাগ (ব্রজলাল নাগ) গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা যাদের থেকে জমি কিনেছি তাদের সঙ্গে যোগযোগ করুন। এছাড়া প্রাইম হাসপাতালের মালিক ডা. মাহবুবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের হাসপাতালের সামনে লম্বাতে এক শতাংশ সরকারি জায়গা রয়েছে। কিন্তু নকশা অনুযায়ী রাস্তা থেকে অনেক দূর সরকারি বলা হলে তিনি ফোনের লাইন কেটে দেন।
এছাড়াও শহরের চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সংলগ্ন মাঠ, নোয়াখালী সুপার মাকের্টের পেছনের অংশ ও পৌর বাজারের সামনের সড়কের খাল দখলসহ কয়েক স্থানে রাস্তার পাশে গণপূর্তের খালি জায়গায় বালু ফেলে ও বাঁশ দিয়ে ঘিরে জমি দখলের মহোৎসব চলছে। অনেকে একতলা ভবন নির্মাণ করে ভাড়া দিয়ে আসছেন। এসব ভবন নির্মাণে মানা হচ্ছে না নোয়াখালী পৌরসভার বিল্ডিং কোড।
এজন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাকে দায়ী করেছে এলাকাবাসী। স্থানীয়রা জানান, গণপূর্ত অফিসের কাছেই অসংখ্য জায়গা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। এতে বুঝা যায় তারা অনৈতিক সুবিধা গ্রহণ করে এসব দখলে মদদ দিচ্ছেন।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের নোয়াখালী নির্বাহী প্রকৌশলী সা’দ মোহাম্মদ আন্দালিব দখলের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, আমাদের জনবল কম থাকায় ইচ্ছা থাকলেও অনেক কিছু করা যায় না। তবে অচিরেই গণপূর্তের খাসজমি উদ্ধারে হাসপাতাল রোডসহ সব জায়গায় অভিযান চালানো হবে।
নোয়াখালী জেলা প্রশাসক (ডিসি) দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, বিষয়টি আমাদের নজরে আসার পর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মিল্টন রায়কে প্রধান করে ৫ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ কমিটি কাগজপত্র যাচাই করে সরকারি জায়গায় অবৈধ দখলদার উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করবে।