জননী সাহসিকা বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল তার ‘ডাকিছে তোমারে’ কবিতায় বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করেছিলেন এভাবেই। আরেক বিখ্যাত লেখক ও কবি অন্নদাশঙ্কর রায় তার ‘বঙ্গবন্ধু’ কবিতায় লেখেন ‘দিকে দিকে আজ অশ্রুগঙ্গা, রক্তগঙ্গা বহমান-নাহি নাহি ভয়—তবু হবে জয়, জয় শেখ মুজিবুর রহমান।’
আজ শোকাবহ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। বাঙালি জাতির জীবনের সবচেয়ে কলঙ্কময় ও বেদনার দিন। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদতবার্ষিকী। নির্মলেন্দু গুণের ভাষায় বলতে হয় ‘এসেছে কান্নার দিন, কাঁদো বাঙালি কাঁদো।’
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাকডাকা ভোরে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি চক্রের ষড়যন্ত্রের শিকার হন স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বৃষ্টিঝরা শ্রাবণের সেই ভোরে বৃষ্টি নয়, ঝরেছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত। ঘাতকের বুলেট বাংলার ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মতো তার বিশাল বুক বিদীর্ণ করে দিয়েছিল। ৩২ নম্বরের সিঁড়ি বেয়ে রক্তস্রোত মিশে গিয়েছিল পতাকায়; বাংলার শ্যামল-সবুজ প্রান্তরে, বঙ্গোপসাগরে। ষড়যন্ত্রকারীরা বাঙালির ললাটে এঁটে দিয়েছিল কলঙ্কের তিলক। যে কলঙ্ক থেকে দেশ-জাতি আজও পুরোপুরি মুক্তি হতে পারিনি। কারণ, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় আংশিক কার্যকর হয়েছে। এখনো দণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন খুনি পালিয়ে রয়েছে বিদেশে। তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের মধ্য দিয়েই কলঙ্কমুক্ত হওয়ার আশায় দিন গুনছে জাতি।
সেদিন ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশুপুত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল। জঘন্যতম এ হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছেলে আরিফ, মেয়ে বেবি ও সুকান্ত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবনেতা ও সাংবাদিক, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন। ওই সময় বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা (বর্তমান প্রধানমন্ত্রী) ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় তারা প্রাণে রক্ষা পান।
বঙ্গবন্ধু যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গঠন করতে দিনরাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন, তখনই তাকে হত্যা করা হয়। পরিসমাপ্তি ঘটে একটি ইতিহাসের। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সেই রক্ত, রক্তজবার মতো ফুটে আছে বাঙালির হৃদয়ে। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী চেতনা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এখন বিশ্বের অনেক নেতার কাছে আদর্শ।
বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি থাকাকালে) প্রেসসচিব প্রয়াত তোয়াব খান স্মৃতিচারণ করে বলেছিলেন, ‘হাজার বছরের মধ্যে বাঙালির জীবনে কোনো দিন স্বাধীন রাষ্ট্র হয়নি। বাঙালির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু, বাঙালির সহস্র বছরের স্বাধীন রাষ্ট্রীয় সত্তার প্রতিষ্ঠাতা। সে হিসেবে তিনিই মহানায়ক, মহান রাষ্ট্রনায়ক। অর্থাৎ রাষ্ট্রনায়কের যে গুণাবলি প্রয়োজন হয় একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের মানবগোষ্ঠীকে তার স্বাধীন সত্তায় প্রতিষ্ঠিত করতে, তার সবগুণই বঙ্গবন্ধুর মধ্যে দেখা গিয়েছিল।’
বঙ্গবন্ধু পরাধীন, অবহেলিত ও নিষ্পেষিত এই জাতিকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছিলেন। বাঙালির হাজার বছরের স্বাধীনতার স্বপ্নকে তিনি বাস্তবায়িত করেছিলেন, স্বাধীনতার স্বাদ বাঙালিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এ দেশের দুঃখী-দরিদ্র মানুষের জন্য বঙ্গবন্ধুর নিরন্তর, নিরলস সংগ্রাম এবং দাবি আদায়ে দীর্ঘ কারাবাসের মুখে দৃঢ় মনোবল তাকে করে তুলেছিল জীবন্ত কিংবদন্তি।
বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাংলার স্বাধীনতা ও বাঙালি জাতিসত্তার প্রতিষ্ঠা। শৈশব-কৈশোর থেকে তিনি এই আদর্শ নিয়েই বড় হয়ে ওঠেন। নিজেই নিজেকে প্রস্তুত করে তোলেন। তার এই চারিত্রিক দৃঢ়তার পেছনে ছিল গভীর অধ্যয়ন, জানা-চেনা-শোনা ও দেখার গভীর অন্তদৃষ্টি।
ইতিহাসবিদদের মতে, একটি বৃহৎ পরাশক্তির ছত্রছায়ায় প্রণীত সুপরিকল্পিত প্রয়াস ছিল ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থান। দিনটি শুধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার পরিবারের সদস্য এবং আরো কয়েকজনের হত্যাকাণ্ডের স্মারক বা আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুতির ঘটনা নয়। এটি ছিল রাষ্ট্র শাসন এবং সরকারি যন্ত্রের ভিন্ন পথে সম্পূর্ণ বিপরীত স্রোতে যাত্রার সূচনা। এই অভ্যুত্থান ছিল গভীর চিন্তাপ্রসূত এবং বৃহৎ পরাশক্তির সুপরিকল্পিত প্রয়াস। কিন্তু ওরা ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিটি রক্ত কণা থেকে এক একটি বঙ্গবন্ধু সৃষ্টি হয়েছে বাঙালির ঘরে ঘরে। তিনি মিশে আছেন বাংলার মাটি, আলো, বাতাসে। ষড়যন্ত্রকারীরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করলেও তার আদর্শ ও চেতনাকে হত্যা করতে পারেনি। হত্যা করতে পারেনি তার লালিত স্বপ্নকে। বঙ্গবন্ধু যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তারই কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে সেই লক্ষ্যেই অদম্যগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।